জিবরানের আকাশ মেরি হাস্কেল

কাহলিল জিবরানের মৃত্যুর পর মেরি হাস্কেল লিখেছিলেন নিজের ডায়েরিতে—

“আজ থেকে আমি আর কেবল মেরি নই। আজ থেকে আমি সেই নারী, যার বুকের ভেতরে এক মৃত মানুষ বেঁচে থাকবে চিরকাল।”

ভালোবাসা যদি ভালোবাসার মতোই হয়,তবে তা আকাশ হয়।ভালোবাসা কখনও মানুষকে সীমাবদ্ধ করেনা বরং আরও বিস্তৃত করে।
মেরি হাস্কেল কাহলিলের আকাশ হয়েছিলেন।

মদ্যপ পিতার উদাসীনতা,আর্থিক টানাপোড়েন,দুর্দুর্নীতির দায়ে বাবার কারাভোগ এসব নিয়েই কেটেছে জিবরানের শৈশব।আর্থিক উন্নতির আশায় মা তাদের চার ভাইবোনকে নিয়ে পাড়ি জমান আমেরিকায়।মাত্র আঠারো বছর বয়সে দেড়বছরের ব্যবধানে কাহলিল মাসহ তার তিন সহোদরকে হারান মারণব্যাধি যক্ষায়।

জিবরানের জীবনে মেরি হাসকেলের ভূমিকা ছিল অনন্য। শুধু জীবনে নয়, মৃত্যুর পরও তিনি জিবরানের কর্মের রক্ষক হয়ে ওঠেন।

তাদের প্রথম পরিচয় ঘটে ১৯০৪ সালে, বোস্টনে খলিল জিবরানের প্রথম শিল্পপ্রদর্শনীতে। পরিচয়ের সূত্র ছিলেন ফটোগ্রাফার ফ্রেডেরিক হোল্যান্ড ডে। তখন জিবরানের বয়স একুশ, আর মেরি হাসকেলের একত্রিশ। সেই আকস্মিক সাক্ষাৎ তাদের জীবনের গতিপথ বদলে দিয়েছিল।

পরবর্তী পঁচিশ বছর ধরে দু’জনের মধ্যে গড়ে ওঠে এক দীর্ঘস্থায়ী, জটিল অথচ গভীর সম্পর্ক।যা কখনো প্রেম, কখনো বন্ধুত্ব, কখনো সৃজনের সহযোগিতায় প্রসারিত হওয়া প্রান্তর। মেরির ভালোবাসা ও আস্থা জিবরানকে শুধু মানসিক শক্তিই দেয়নি, দিয়েছে তার শিল্পচর্চার জন্য ভরসাযোগ্য ভিত।

জিবরানের শিল্পীসত্তাকে বিকাশের জন্য মেরিই প্রথম হাত বাড়ান। তিনি জিবরানকে প্যারিসে পড়াশোনার সুযোগ করে দেন। সে সময় তিনি প্রতি মাসে ৭৫ ডলার ভাতা দিতেন।যা আজকের হিসেবে প্রায় দুই হাজার ডলারের সমান। এই সহায়তা জিবরানকে ইউরোপে শিল্পচর্চার সুযোগ করে দিয়েছিল, আর পরোক্ষভাবে জন্ম দিয়েছিল সেই সাহিত্যকীর্তির, যা আজ বিশ্বজোড়া আলো ছড়াচ্ছে।

কাহলিল জিবরান এক চিঠিতে মেরি হাসকেলকে লিখেছিলেন—

আমাদের মধ্যে দূরত্ব থাকা দরকার। কারণ দূরত্বই আমাদের আত্মাকে প্রসারিত করে, যেমন আকাশের দূরত্ব তারাদের আলাদা রাখে, অথচ একসাথে আকাশকে পূর্ণ করে।

মেরি হাস্কেল,জিবরানের আকশ হয়েছিলেন।তিনি তারার মতোই উজ্জ্বল হতে দিয়েছিলেন জিবরানকে।

জিবরানের জীবনের পরবর্তী পর্যায়ে মেরিই ছিলেন তার অটুট আশ্রয়। জিবরানের মৃত্যু পরেও তিনি তার রচনার পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ করেন, সম্পাদনা করেন এবং প্রকাশ করেন। এক অর্থে জিবরানের মৃত্যুর পর তার চিন্তা, দর্শন ও সাহিত্যকীর্তি বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার নেপথ্যে মেরি হাসকেলের অবদানই ছিল অন্যতম।

পুনশ্চ:কাহলিল জিবরানের নিজের করা পোর্ট্রেট-এ মেরি হাস্কেল এবং তিনি নিজে।

Similar Posts